মাল্টিপ্লেক্স কালচার

0

মাহফুজুর রহমান

মাল্টিপ্লেক্স’ শব্দটা আমরা প্রথম শুনি ২০০৪ সালে বসুন্ধরা শপিংকমপ্লেক্সে স্টার সিনেপ্লেক্স যাত্রা শুরু করার পর। অথচ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে মাল্টিপ্লেক্স বহু বছর ধরেই ছিল। কিন্তু এই কালচারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেনি, কারণ আমাদের দেশে বিদেশি ছবি তেমন একটা চলত না। মাল্টিপ্লেক্স তখনই জনপ্রিয় হয়, যখন সেখানে নানা দেশের নানা ভাষার ছবি দেখার সুযোগ থাকে। তারপরও সিনেপ্লেক্স এ দেশে ধীরে ধীরে বাজার ধরতে থাকে।

ভারতের দর্শকরা মাল্টিপ্লেক্স শব্দটি প্রথম শোনে ১৯৯৭ সালে দিল্লিতে মাল্টিপ্লেক্স পি.ভি.আর চালু হওয়ার পর। কলকাতায় মাল্টিপ্লেক্স আসতে আসতে লেগে যায় প্রায় ছয় বছর। ঢাকায় মাল্টিপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার বছরখানেক আগে কলকাতায় চালু হয় আইনক্স-এর মাল্টিপ্লেক্স। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ কাছাকাছি সময়ে মাল্টিপ্লেক্স কালচারে ঢুকলেও ওদের উন্নতি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি।

৫/৬ বছর আগে ‘বেলাশেষে’ ব্লকবাস্টার হওয়ার সময় ওখানে মাল্টিপ্লেক্স ছিল পঁচিশটার মতো। এখন হয়তো বেড়ে ত্রিশটার কাছাকাছি গেছে। অন্যদিকে ২০০৯ সালে ভারতজুড়ে মাল্টিপ্লেক্স ছিল ৯২৫টা। ২০১৯ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২০০টা। পশ্চিবঙ্গসহ ভারতের প্রত্যেকটা রাজ্যে মাল্টিপ্লেক্স কালচার একেবারে সুপ্রতিষ্ঠিত।

মাল্টিপ্লেক্স কালচার জনপ্রিয় হওয়ার পর কলকাতার সিনেমা আপাদমস্তক বদলে যায়। মাল্টিপ্লেক্সে ঋতুপর্ণ ঘোষ সেকেন্ড ইনিংস শুরু করেন। কৌশিক গাঙ্গুলি, সৃজিত মুখার্জি, শিবপ্রসাদরা হয়ে ওঠেন মেইনস্ট্রিম, আর সুজিত গাঙ্গুলি, রাজ চক্রবর্তী, স্বপন সাহারা হয়ে যান অফট্র্যাক। মাল্টিপ্লেক্সকে কেন্দ্র করে আর্টহাউজ সিনেমা সেখানে বিজয়নিশান ওড়ায়; সেই নিশান এখনো উড়ছে।

২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর সিনেপ্লেক্স কালেভদ্রে ‘মোল্লাবাড়ির বউ’, ‘মনপুরা’, ‘আয়নাবাজি’র মতো সুপারহিট ছবি পেয়েছে। সারাবছর ওখানে বাংলা ছবি চলেছে নামে মাত্র। ইংরেজি ছবি দিয়েই তারা ব্যবসা ধরে রেখেছে। শুক্র-শনি সিনেপ্লেক্সে টিকেট পাওয়াও মুশকিল, অথচ অন্যদিন খাঁ খাঁ। মাল্টিপ্লেক্স কালচারটাই তো তাই- ছুটির দিনে শপিংমলে ঘোরাঘুরি, খাওয়াদাওয়া আর ছবি দেখা।

সিনেপ্লেক্স-এর প্রায় ১০ বছর পর দেশে আরেকটা মাল্টিপ্লেক্স আসে যমুনায়- ব্লকবাষ্টার সিনেমাস। এখানেও বাংলা ছবিতে দর্শকখরা, ইংরেজি ছবিতে অতটা নয়। তারপর লম্বা শীতনিদ্রা শেষে গত তিন বছরের মধ্যে ধানমন্ডি, মহাখালী, মিরপুরসহ সর্বশেষ কেরানীগঞ্জে দেখা মিলল মাল্টিপ্লেক্সের। দেড় দশকের বেশি সময় পর বাংলাদেশ প্রবেশ করছে সত্যিকারের মাল্টিপ্লেক্স যুগে।

কিন্তু আমরা এমন এক সময় মাল্টিপ্লেক্স কালচারে ঢুকছি যখন গোটা দুনিয়া আরেকটা নতুন যুগে ঢুকে গেছে। সেই যুগের নাম ‘ওটিটি’। ‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও পিছে।’ মাল্টিপ্লেক্স যুগে আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম ভাঙার পর দেখি দর্শকরা সব ঘরে বসে সিনেমা দেখার অভ্যাস রপ্ত করে নিয়েছে।

ওটিটি আসার অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশের দর্শকরা সিনেমা হলবিমুখ। তারা ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারজাতীয় ব্যবস্থার সঙ্গে সুপরিচিত। এখানে ঘরে বসে সিনেমা দেখাকেই বড় বড় সংস্থা উৎসাহ দিয়ে এসেছে। ফলে সিনেপ্লেক্সে গিয়ে ছবি দেখার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি; তৈরি হয়নি এমন একদল নির্মাতা যাদের ছবি সিনেপ্লক্সে নিয়মিত হাউজফুল হয়!

উল্টো ওটিটি আসার পর দেখা গেল, যারা সিনেপ্লেক্সকে টার্গেট করে ছবি বানাতেন, তারা ওয়েব ফিল্ম বানানো শুরু করলেন। গত কয়েক বছর ধরে যারা টেলিফিল্ম বানিয়ে সিনেমা নির্মাণের হাতমশক করছিলেন, তারা সিনেমার স্বপ্নের কাঁথায় আগুন দিয়ে ওয়েব ফিল্ম বানাতে শুরু করলেন। একদিকে পরের পর মাল্টিপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে, আরেকদিকে ঘরে বসে সিনেমা দেখার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।

আসলে আমরা যত দ্রুত ওটিটিকে আপন করে নিয়েছি, তত দ্রুত কিন্তু মাল্টিপ্লেক্সকে আপন করে নিতে পারিনি। কারণ, ১০০০ সিনেমা হল থাকার যুগে ঘরে বসে বিজ্ঞাপনের ফাঁকে সিনেমা দেখা প্রজন্ম আমরা। টিকেট কেটে বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র দেখতে আমরা অভ্যস্ত নই। তাই আমরা বলছি, সিনেমা হল বলে কিছু থাকবে না, যা থাকবে তার নাম ওটিটি।

এই যে কলকাতায় ‘বেলাশেষে’র সিকুয়েল ‘বেলাশুরু’ রিলিজ হলো, এটাকে দলে দলে মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে সুপারহিট করে দেবে ওখানকার দর্শকরা। ওদের ওখানে আমাদের চেয়ে ঢের উন্নত ও পেশাদার ওটিটি আছে, হাজারো কন্টেন্ট মজুদ; তবুও ওরা সিনেমা হলে যাবে। ওদের নির্মাতারা অন্ধের মতো ‘ওটিটিই ভবিষ্যৎ’ ‘ওটিটিই ভবিষ্যৎ’ বলে-বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলবে না।

আমাদের সিনেমা হল ১৪০০ থেকে নেমে গেছে দুই শ-তে। সিঙ্গেল স্ক্রিন পুরো পৃথিবীতেই কমেছে, বেড়েছে মাল্টিপ্লেক্স। ২০০৯ সালে ভারতে সিঙ্গেল স্ক্রিন ছিল ৯৬০০টা, ২০১৯ সালে কমে হয়েছে ৬৩০০টা। নদীর একদিকে গড়ে, আরেকদিকে ভাঙে।

এতদিনে মাল্টিপ্লেক্সের ঢেউ লাগছে বঙ্গভূমিতে। অসংখ্য ছবি হওয়া দরকার, কেননা মাল্টিপ্লেক্সের অগাধ ক্ষুধা। তাই ওটিটির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে না থেকে থিয়েটারের জন্যও ছবি বানানো জরুরি। দেশে যে মাল্টিপ্লেক্স কালচার বেড়ে উঠছে, প্রচুর ছবি উৎপাদন ও সরবরাহ করে সে কালচারকে প্রতিষ্ঠা দেয়াটাই চলচ্চিত্রবিপ্লবের সমান এখন।

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.