উপমহাদেশের বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল
রহস্যের অপর নাম বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল। আশ্চর্য ত্রিভুজ ঘিরে বিস্ময়ের খনি জমে আছে অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীদের মনে। কন্সপিরেসি থিয়োরি অর্থাৎ যাঁরা উদ্ভট সব তত্ত্বে বিশ্বাসী, তাঁদের কাছে এই ট্রায়াঙ্গেলের স্থান মহিমা বলে বোঝানোর নয়। তবে আটলান্টিক মহাসাগরে তিনটি বিন্দু দ্বারা সীমাবদ্ধ ত্রিভুজাকৃতি ‘ডেভিল’স ট্রায়াঙ্গেল’ পৃথিবীর একমাত্র রহস্য-ত্রিভুজ নয়। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে রয়েছে ‘ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল’। নাম শুনেই বোঝা যায়, জায়গাটা চিনের কাছাকাছি। সেখানেও একই ভাবে দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে অনেক বিমান ।
কিন্তু আপনি জানেন কি! প্রতিবেশী দেশ ভারতেও রয়েছে এমন এক মারণ ত্রিভুজ! মূলত ওড়িশায় অবস্থিত হলেও যার একটি বিন্দু ছুঁয়ে আছে এই বাংলায়ও। গত ৭৭ বছর ধরে এই রহস্যেরও কোনও কুলকিনারা হয়নি এখনও। বরং গবেষনা রুপ নিয়েছে ঘন কুয়াশায়।
শুরুটা হোক শুরু থেকেই। ১৯৪৪ সালের ৪ঠা মে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচে গনগনে পৃথিবী। পরাধীন ভারতেও লেগেছে আগুনের ঢেউ। ভয়াবহ যুদ্ধের সেই সময়টাতে আমারদা রোড বিমানঘাঁটির কাছে মার্কিন লিবারেটর যুদ্ধবিমানের সঙ্গে হার্ভার্ড দ্য হ্যাভিল্যান্ড বিমানের মুখোমুখি এক মারাত্মক সংঘর্ষে মৃত্যু হয় দুই বিমানের চার সদস্যের। এই ঘটনার ঠিক তিন দিনের মাথায় ৭ই মে ঘটে আরও একটি দুর্ঘটনা । টেক অফ করার ঠিক ২০ মিনিটের মধ্যেই ভেঙে পড়ে একটি লিবারেটর যুদ্ধবিমান।বিমানে থাকা ১০ জনেরই মৃত্যু হয় ঐ দূর্ঘটনায়। এর ঠিক সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ১৩ই মে আবারও আমারদা রোড থেকে টেক অফ করার পর পরই ভেঙে পড়ে আরেকটি হাভিল্যান্ড বিমান। তবে এই দুর্ঘটনায় মারা যাননি কেউ।
১৯৪৫ সালের ২৬ জুলাই। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে সেদিনই। দু’টি চার ইঞ্জিনের বোমারু বিমান ব্রিটিশ রয়্যাল যুদ্ধবিমান বি-২৪ ( টুয়েন্টিফোর) লিবারেটরের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। প্রশিক্ষণে ব্যস্ত থাকার সময় ঘটে্ যাওয়া ঐ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ১৪ জনের। বিমানের ধ্বংসাবশেষ এসে পড়ে অবিভক্ত বঙ্গদেশেও।
সেই শুরু থেকেই একই অঞ্চলে কয়েক মাসের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো ঘিরে জনমনে গড়ে ওঠে এক ভয়াবহ আতঙ্ক। রহস্যের কুয়াশায় আবর্তিত হয় রুপকথার নানাগল্প। ঠিক যেমনটা রয়েছে বারমুডাকে ঘিরে। ওড়িশার আমারদা রোড বিমানঘাঁটি, ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়া এবং বাঁকুড়ার নিকটবর্তী পিয়ারডোবার কাছে তিনটি বিন্দুকে যোগ করলে যে ত্রিভুজাকৃতি এলাকা তৈরি হয় ঠিক সেখানেই বারবার ভেঙে পড়েছে বিমানের ধ্বংসাবশেষ। গবেষক অনিল ধীর জানিয়েছেন, এযাবৎ ১৬টি বিমান দুর্ঘটনাই ঘটেছে ওড়িশার বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে।
কখনও কখনও বিমানগুলির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেলেও একেবারেই খুঁজে পাওয়া যায়নি এমন ঘটনাও কিন্তু রয়েছে। শেষবারের দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ২০১৮ সালে। তবে সব ক্ষেত্রেই একটা বিষয় ছিল বেশ লক্ষনীয়। যেমন-আবহাওয়া ছিল চমৎকার, অন্তত দুর্ঘটনা ঘটার মতো নয়। বিমানগুলিতে যান্ত্রিক কোন গোলমালও ছিল না। তাহলে প্রশ্ন আসে, কেন বার বার ঘটেছে এমন দূর্ঘটনা। আর এই অমোঘ প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে বেড়াচ্ছেন কৌতূহলী মানুষ। যার উত্তর মেলেনি আজও।
২০১৮ সালে ঘটা শেষবারের দুর্ঘটনায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বিমান চালকের মুখ থেকেই শোনা গিয়েছিল লোমহর্ষক বিবরণ। দূর্ঘটনাকবলিত বিমানটির চালক জানান, আমারদা বিমানঘাঁটির উপর দিয়ে ওড়ার সময়ই হঠাৎ করেই বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন তিনি। খুব দ্রুতই নিচের দিকে নামতে থাকে বিমান। অথচ তার আগে বিমানে কোনও সমস্যাই ছিল না। কিন্তু ওই এলাকায় আসার পর পরই এত দ্রুত নিচের দিকে নামতে থাকে বিমানটি যেন কোন এক অদৃশ্য আকর্ষণশক্তি টেনে নিচের দিকে নামিয়ে আনছে। এ ঘটনায় থতমত খেয়ে যান বিমান চালক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি দেখতে পান বিমানটি নিচে নেমে এসেছে একেবারেই নিচে। লাফিয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও সারা জীবনের জন্য মনের মধ্যে ধরে রাখেন আতঙ্কের এক হাড়হিম ছবি।
প্রশ্ন হলো কেন ঘটে এমন ঘটনা ? এ বিষয়ে রয়েছে নানা থিয়োরি, নানা গবেষনা। আর রুপকথার গল্প তো আছেই। তবে সবচেয়ে বেশি শোনা যায় যে ব্যাখ্যা তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অধুনা পরিত্যক্ত আমারদা বিমানঘাঁটি। ১৯৪০ সালে ৩ কোটি টাকা খরচে গড়ে ওঠা ওই ঘাঁটি এখন পরিত্যক্ত। অথচ সেই চল্লিশের দশকে তা ছিল ব্যস্ততায় ভরা।
এক গবেষনায় বলা হয়, এই বিমানঘাঁটির কাছেই রয়েছে ঝাড়খণ্ডের জাদুগোরা ইউরেনিয়াম খনি। এই তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামের প্রভাবেই বিকল হয়ে যেতে পারে যন্ত্রপাতি। সঙ্গত কারণেই বিমানের রাডার সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। যা থেকে দুর্ঘটনা ঘটা বিচিত্র কিছু নয়।
কিন্তু এই থিয়োরির সার সংক্ষেপ আজও বাস্তব অর্থে প্রমাণিত হয়নি। আবার এমনও মনে করা হয়, সরকারি গবেষণায় এর কারণ সম্পর্কে হয়তো কিছুটা জানা গিয়েছে। তবে তা ‘টপ সিক্রেট’ হিসেবেই রয়ে গিয়েছে। কেননা আজও কোন বেসরকারি সংস্থাকে এ বিষয়ে তদন্ত করার অনুমতি দেয়া হয়নি।
কেউ কেউ মনে করেন, যে বিমানগুলির খোঁজ মেলেনি সেগুলো মোটেই অদৃশ্য হয়ে যায়নি। বরং তাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে বঙ্গোপসাগরের গভীর তলদেশে। দীর্ঘ ৭৭ বছরের এই ধাঁধার উত্তর কখনো কি মিলবে? সেই উত্তর রয়ে মহাসাগরের অতল দেশেই।