প্রত্যাশার প্রতিটি নতুন বছরে

0

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

নতুন বছর আসে নতুন আশা নিয়ে। মনে করা হয় যে দিন বদলাবে। কিন্তু বদলায় না; এবং বদলায় না যে সেই পুরাতন ও একঘেয়ে কাহিনিই নতুন করে বলতে হয়। না বদলানোর কারণ একটি ব্যাধি, যার দ্বারা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র আক্রান্ত। ব্যাধিটির নাম পুঁজিবাদ। এই ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য আমাদের চেষ্টার অবধি নেই। রাজনৈতিকভাবে আমরা বারবার চেষ্টা করেছি কিন্তু সফল হইনি।

কিন্তু মুক্তি যে আসেনি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জিনিসপত্রের দাম থেকে শুরু করে জীবনের সবক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব পর্যন্ত সর্বত্রই ব্যর্থতার স্মারকচিহ্নগুলো জ্বলজ্বল করছে। সবকিছুই গা-সওয়া হয়ে যায়। তবে মাঝেমধ্যে দুয়েকটি ঘটনা ঘটে যাতে আমরা ধাক্কা খাই, চমকে উঠি, পরস্পরকে বলি যে আমরা তো ভালো নেই, কঠিন বিপদের মধ্যে রয়েছি।

আত্মহত্যার সংবাদ প্রায় সংবাদপত্রে দেখা যায়। আত্মহত্যা কেউ এমনি এমনি করে না। যন্ত্রণা কেমন দুঃসহ হলে, হতাশা কতটা গভীরে চলে গেলে, নিঃসঙ্গতা কী পরিমাণে বৃদ্ধি পেলে একজন তরুণ আত্মহত্যা করে, মনে করে যে তার জন্য মৃত্যুই হচ্ছে বাঁচার একমাত্র উপায়, তা বাইরে থেকে বোঝা যাবে না, এমনকি কল্পনা করাও সম্ভব নয়। জানে তা শুধু ভুক্তভোগী। আত্মহত্যার ঘটনা ঘন ঘন ঘটছে; সবাই যে ওই পন্থাকেই বাঁচার একমাত্র উপায় বলে মনে করে তা নয়, অনেকে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকে, জীবনকে কঠিন বোঝা মনে করেও কোনোমতে টিকে থাকে; টিকেই থাকে শুধু, বেঁচে থাকে না।

মেয়েরাই আত্মহত্যা করে বেশি, কেননা দুঃখের ঝড়ঝাপটাগুলো তাদেরই আক্রমণ করে প্রথমে এবং সহজে। ঘরে এবং ঘরের বাইরে, পথে, কর্মস্থলে, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। খাদ্যের অভাব হলে বনের বাঘ জনপদে চলে আসে। বনের বাঘের জন্য সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু মানুষ যখন ক্ষুধার্ত বাঘে পরিণত হয় তখন সেই অস্বাভাবিকতাটা যে কেমন ভয়ংকর হতে পারে, দেশে ঘটে চলা আত্মহত্যা তারই নিদর্শন বটে।

যেসব যুবক মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে, দেখা যাবে তাদের অধিকাংশেরই কাজ নেই, কারও কারও কাজ থাকলেও কাজের কাজ নেই। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাকেই তারা বীরত্ব প্রদর্শনের সবচেয়ে সহজ পন্থা বলে মনে করে। তারা ভয় পায় না, কেননা তাদের শাস্তি হয় না। পাড়ায়, মহল্লায় স্কুলের সামনে মেয়েরা সন্ত্রস্ত থাকে। অভিভাবকরা নিজেদের নিতান্ত অসহায় অবস্থায় দেখতে পান। কর্মহীন এ বখাটেদের পেছনে রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। এরা দলের কাজে লাগে, দলও এদের কাজে লাগায়।

দল বদলাতে এদের যে সময় লাগে তাও নয়। সামাজিক চাপে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধের আইন বিধিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু সে আইনকে যে আরও বিস্তৃত ও শক্ত করা আবশ্যক, মেয়েদের আত্মহত্যার ঘটনা সেই সত্যটাকেই জানিয়ে দেয়। আইনের প্রয়োগকেও কঠোর করা দরকার; সেই সঙ্গে আইনের বিধিগুলোর প্রচার ও তাদের প্রয়োগের দৃষ্টান্ত জনসমক্ষে তুলে ধরাও আবশ্যক।

কিন্তু যে ব্যাধির কারণে নির্যাতন ও আত্মহত্যা ঘটছে সেটা তো শুধু আইনের পরিধির বিস্তার এবং প্রয়োগের নিশ্চয়তা ও যথার্থতা দিয়ে দূর করা যাবে না, ব্যাধিটিকে উৎপাটিত করা চাই। পুঁজিবাদের যে গুণ নেই তা নয়, অবশ্যই আছে। সামন্তবাদের তুলনায় সে অবশ্যই উন্নত। ব্যক্তিকে সে স্বীকার করে, মর্যাদাও দিতে চায়, কিন্তু তার যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা তাতে ব্যক্তিকে যে নিরাপত্তা দেবে সে-কাজটি সে করতে পারে না।

পুঁজিবাদ ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন ও আত্মকেন্দ্রিক করে, তাকে ভোগবাদী হতে উৎসাহ দেয়। এর ফলে দুর্বল যাদের অবস্থান সেই ব্যক্তিরা অর্থাৎ দরিদ্র, শিশু ও মেয়েরাÑযাদের হাতে বিত্ত ও ক্ষমতা রয়েছে তাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হয়। আমরা স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা অহরহ বলি, কিন্তু সব মানুষের মুক্তি তো কিছুতেই আসবে না যদি না পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সেখানে প্রকৃত গণতান্ত্রিক অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা না ঘটাই। মুক্তির জন্য আমরা যে সংগ্রাম করিনি তাও নয়, কিন্তু মুক্তির জন্য সমাজব্যবস্থার অত্যাবশ্যক পরিবর্তনের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চাই না। সূত্র- কালবেলা

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.