অবশেষে পান ছেড়েছেন তিনি!
রাত তখন প্রায় তিনটা। উনার জন্য পান আনতেই হবে। নিউইয়র্কের রাস্তায় ঘুরে একটি বাঙালি শপ থেকে কয়েক ডলারের পান নিয়ে এলাম। বলছিলাম ২০১৫ সালের কথা। পান পাওয়ার পর উনি যে হাসি দিলেন, তা এখনো আমার চোখে ভাসে। আমেরিকা যাওয়ার সময় তিন বিড়া পান নিয়ে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস লাগেজের ভেতরে রাখা সে পান নিতে মার্কিন প্রশাসন বাধা দেয়নি। বিপত্তি হয়েছিল সেই পান শেষ হওয়ার পরই।
বহু চেষ্টা করেছি পান খাওয়া ছাড়াতে, পারিনি। পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের অনেকেই রিকুয়েস্ট করেছে, তবুও উনি পান ছাড়বেন না। বাজার থেকে প্রতি সপ্তাহে বিড়ায় বিড়ায় পান আনা অস্বাভাবিক নয় কি! কোনো কোনো দোকানদার হয়তো ভাবতো, আমি ঘনঘন বিয়ের দাওয়াতে যাই পান নিয়ে। কিন্তু দোকানদার কি জানতো, আমার ঘর সামলাতে হয় পান দিয়ে!
উনি শুধু পান খেতেন এমনটি না, পান বিলাতেও পছন্দ করতেন। অন্যকে পান খাওয়া শেখাতেন। পানের উপর বয়ান রাখতেন। ফজিলত বর্ণনা করতেন। পান দিয়ে বন্ধুত্ব করতেন। পানের সাথে চুন ছাড়াও থাকতো রকমারি জর্দা। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে অনুষ্ঠান শেষে পানের শাহী বাটা বের করে বসতেন। পান খাওয়ার আসর জমাতেন। পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে কেউ কেউ উনার কাছ থেকে পান চেয়ে নিতেন। এমনকি কদাচিৎ আমিও পান চেয়ে নিতাম!
আমি বলতাম, তোমার পান খাওয়া দেখে মনে হয়, তুমি পান খাও না, বরং পান তোমাকে খায়। বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল, উনি হয়তো আর কোনোদিন পান ছাড়বেন না বা ইচ্ছা থাকলেও ছাড়তে পারবেন না। অবশেষে খোদাতায়ালার মর্জিতে অসম্ভব সম্ভব হলো! গত ৮ ডিসেম্বর ২০২৩, রোজ শুক্রবার, বেলা সাড়ে তিন ঘটিকায়, উনি ঘোষণা দিলেন, “আমি আর পান খাব না।”
একেবারেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। তবে বিগত ২৮ বছরে উনাকে মিথ্যা বলতে শুনিনি। অত্যন্ত ধার্মিক, সদালাপী ও বিশ্বস্ত মানুষ। তবে কিছুটা সন্দিহান ছিলাম এই ভেবে যে, প্রায় দেড়যুগের অভ্যেস উনি কী করে পাল্টাবেন। অবাক হয়েছি ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্তে। পানের দাগ মুছে ফেলতে চান। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি সত্যিই পান ছাড়তে পারবে? এবার উনি জানালেন আত্মোপলব্ধির কথা।
গত দু’মাসে তিনবার হাসপাতালে যাওয়ায় ডাক্তার উনাকে সতর্ক করে বলেছেন, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের পাশাপাশি অতিরিক্ত পান খাওয়ার কারণে শরীরে বেশ কিছু সমস্যা হচ্ছে, যা পরে আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ডাক্তার আরো বলেছেন, পান না ছাড়লে তিনি আর উনার চিকিৎসা করবেন না! ডাক্তারের অভিমান সহজেই অনুমেয়। তিনি আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক, অত্যন্ত আন্তরিক ও ভালো মনের মানুষ। আমাকেও জানালেন উনার কথা। উনার পান খাওয়ার দায়ভার কিছুটা আমার উপরও চাপালেন। কিন্তু আমি যে নিরূপায় সে কথা ডাক্তারকে কী করে বুঝাই!
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ডেন্টিস্টের কাছে দাঁত ‘ক্লিন’ করার পর তিন সপ্তাহ হয়ে গেল, উনি একটি পানও স্পর্শ করেননি! পানের বাটাটি পরিষ্কার করে সুভেনির হিসেবে আলমিরাতে রেখে দিয়েছেন। সবকিছু অবলোকন করে এখন আমার বিশ্বাস হলো, উনি পান ছেড়েছেন। আল্লাহ চাহেন তো, পান আর খাবেন না।
আমি ভাবতেই পারছি না, পানহীন উনার কথা। উনার পান ছাড়ার খবরে বাসায় যেন উৎসবের আমেজ। শীতকাল বিধায় রকমারি পিঠা-পায়েস এমনিতেই চলছে। সবাই মিলে একটা আনন্দভোজও সারলাম সপ্তাহিক ছুটির দিনে। সত্যি বলতে কি, পারিবারিক ভোজ শেষে আমারই একটু পান খেতে ইচ্ছা হলো! তাই উনার এক পান-বান্ধবির কাছ থেকে ক’টি পান এনে পরিবারের সবাইকে একটু একটু বিলিয়ে দিলাম।
৯. বাবার পান বিতরণ-কাণ্ড দেখে ছেলে লাবিব, মেয়ে রিদা ও জামাতা রোজেন তো হেসে কুটিকুটি। অবাক হলাম, সবাই পান খেলেও উনি কিন্তু খেলেন না! উনি আমাদেরকে বুঝিয়ে দিলেন, দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিলে সবই সম্ভব। পরিশেষে সবার কাছে আমার ‘উনার’ জন্য দোয়া চাই। আল্লাহ যেন উনাকে পানহীন জীবনে সুস্থ রাখেন।