ঘটনা, দুর্ঘটনা ও আমাদের জীবনাচারণ

0

অগ্নি দুর্ঘটনা বাংলাদেশে প্রাকৃতিক কারণে হয় না। আমাদের অসাবধানতাই অগ্নি দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। তাই সচেতন হয়ে অগ্নি দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে আমাদের জীবন ও সম্পদ।
২০১০ সালের নিমতলি ট্রাজেডির কথা আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। ঢাকার নিমতলীতে একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারের বিস্ফোরণ থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিলো আশে পাশের কয়েকটি ভবনে। কয়েকটি দোকানে রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও দাহ্য পদার্থ থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিলো। সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ১২৪ জন মানুষ। আহ! কী বিভৎস ! কত বেদনার ছিলো মানুষের আর্ত চিৎকার।
কিন্তু এরপরও আমরা কতখানি সচেতন হতে পেরেছি?  এই প্রশ্ন আমাদের সবার মনে। কারণ নিমতলি ট্র্যাজেডির পরও চুড়ি হাঁটটা, বনানীতে আগুনে পুড়েছে মানুষের প্রাণ। ২০১২ সালের ২৪ শে নভেম্বর ঢাকা মহানগরীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশন ফ্যাক্টরির ৯ তলা ভবনে আগুন লেগে প্রাণ হারান ১১২ জন পোশাক শ্রমিক। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিলো বলে বিশেষজ্ঞদের ধারনা।

এবার বলি একটি শিল্প দুর্ঘটনার কথা। রানা প্লাজা ট্রাজেডির কথা আমাদের মনে আছে। ২০১৩ সালের ২৪ শে এপ্রিল পোশাক কারখানা রানা প্লাজার ৯ তলা ভবনটি ধ্বসে পড়ে। কয়েকটি তলা মাটির নিচে চলে যায় আর কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের উপর পড়ে। এত এগারশোর বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। বিশ্বের ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনার এটি একটি। আমরা তাও ভুলে গেছি। এভাবেই ভুলে যাই।

আমরা জলের উপরেও জ্বলে পুড়ে ছাই হই। মনে আছে এমভি অভিযান-১০ এর কথা? ২০২১ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে বরগুণার উদ্দেশ্যে লঞ্চটি যাত্রা শুরু করেছিলো। ২৪ ডিসেম্বরের ভোরের সূর্য অনেকেই দেখতে পারেন নি। দেখেছেন আগুনের লেলিহান শিখা। ঝালকাঠি জেলার আওতাধীন সুগন্ধা নদীতে লঞ্চটির ইঞ্জিন বিস্ফোরিত হলে পুরো লঞ্চে আগুন ধরে যায়। আগুনে পুড়ে অন্তত ৩৮ জনের প্রাণহানি ঘটে।

২০২২ সালের ৪ঠা জুন চট্টগ্রামের সিতাকুণ্ডের বি এম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। এক পর্যায়ে মজুদ রাসায়নিকে বিস্ফোরণের ফলে শতাধিক কন্টেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনায় অন্তত ৪১ জন নিহত হন এবং ৪৫০ জনের বেশি আহত হন। ২০১৯ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানী ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঘটনান্থল থেকে উদ্ধারকর্মীরা ৬৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছিলেন। তবে সব মিলিয়ে সেই দুর্ঘটনায় ৭১ জনের প্রাণহানি হয়েছিলো।

এবার বলছি, ২০১৯ সালের ২৮ শে মার্চের কথা। রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে আর আহত হন অন্তত ৭৫ জন। এমন করে অসংখ্য দুর্ঘটনার কথা তুলে ধরা যায়। আমরা কি তারপরেও সচেতন হবো না? একটি স্বাভাবিক মৃত্যু প্রত্যাশা করতে পারি না?
এবার আসি সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া অগ্নিদুর্ঘটনা প্রসঙ্গে।

২০২৪ সালের ২৯ শে ফেব্রুয়ারি। রাজধানী ঢাকার বেইলী রোডের গ্রীন কোজি বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ভবনটিতে বেশ কয়েকটি রেস্তোরা ছিলো। লিপ ইয়ার উপলক্ষ্যে খাবারের মেনুতে বেশ মূল্য ছাড় ছিলো। অনেকেই পরিবার, বন্ধু বান্ধবসহ খেতে গিয়েছিলেন সেখানে কিন্তু ফিরলেন লাশ হয়ে। পাঁচ জনের পুরো পরিবারের মৃত্যুর ঘটনাও এখানে আছে। অনেকের লাশ সনাক্তে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে লাশের পরিচয় নিশ্চিত করতে হচ্ছে। এসবের মধ্যেও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বলছি বৃষ্টি খাতুন ওরফে সাংবা‌দিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর কথা।

মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠা বৃষ্টি খাতুন কর্মস্থলে ও ফেসবুকে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে পরিচিত। মন্দিরে যাতায়াতের বিষয়টি নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। একদিকে মুসলিম পিতা লাশ দাফনের অপেক্ষায় রয়েছেন। অন্যদিকে মন্দির কর্তৃপক্ষ তাকে সনাতন ধর্মাবলম্বী ও ভারতীয় নাগরিক দাবি করে লাশ দাহ করার অপেক্ষায় আছেন। এমন পরিবেশ তৈরি হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে বৃষ্টি খাতুন ওরফে অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর জীবনাচারণ।

প্রত্যেককেই নিজ ধর্মের অনুশাসন মেনে সমাজে চলা উচিত। দৃঢ় ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষকে কখনো ছোট করে না বরং সম্মানিত করে। ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতি ও নৈতিকতার শিক্ষা ছেলে-মেয়েদেরকে দিতে হবে। একটি মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়ের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে সমাজের সন্দেহ পোষণ করতে হয় এ বিষয়টি আমার কাছে খুবই আশ্চর্য লে‌গে‌ছে। হয়তো এর পেছনে দুর্বল ধর্মীয় মূল্যবোধ বা কোন মোহ রয়েছে। একজন মুসলিম হিসেবে বলতে পারি পবিত্র ইসলামের সুমহান আদর্শের ছোঁয়া যে ব্যক্তি একটু হলেও পেয়েছে সে অন্তত ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করতে পারেনা। তবে এমন ঘটনা যে পৃথিবীর কোথাও ঘটেনি তা নয়।

ক্ষমতা, লোভ, খুব ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষা, উন্নত জীবনযাপনের হাতছানি অনেক সময় মানুষকে ‌মোহা‌বিষ্ট বা অন্ধ করে দেয়। একজন সত্যিকারের মুসলিম কখনো ধর্ষক হবে না, মিথ্যে বলবে না, দুর্নীতি করবে না, কাউকে কষ্ট দেবে না। সে সমগ্র জীবন সততা-নিষ্ঠার সাথে চলবে। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি হবেন একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব। কিন্তু বাস্তবে আমরা তা দেখছি না। এটা আসলে দুর্বল ঈমানের বহিঃপ্রকাশ। মুসলিম হয়েও পরবর্তীতে ধর্মে বিশ্বাস হারিয়েছেন এমনও অনেক আছে।

যাই হোক আবার বৃষ্টি খাতুন ওরফে অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর প্রসঙ্গে আসি। তিনি চলে গেছেন তার কোন দায়িত্ব নেই কিন্তু তাকে ঘিরে এখনো অনেক আয়োজন বাকি। তাকে নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে। প্রশ্ন জাগে কেন সে সবাইকে এমন পরিস্থিতির দিকে রেখে গেল? সেকি সত্যিকার অর্থে মুসলিম? সেকি মুসলিম পরিবারের সন্তান? মুসলিম হলে কেনইবা তার নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী? তাঁর জন্ম ভারতের বেনারসে এমন কথা কেন উঠছে? পুরো বিষয়টি অনেক জল্পনা কল্পনার জন্ম দিয়েছে।

তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, রাজধানীর বেইলি রোডে আগুনে মারা যাওয়া সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর আসল নাম বৃষ্টি খাতুন। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের বনগ্রামে। তার বাবার নাম শাবলুল আলম সবুজ। সার্টিফিকেট, জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম বৃষ্টি খাতুন। বৃষ্টির বাবা শাবলুল আলম সবুজ ও মা বিউটি বেগম দুইজনই ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তবে বৃষ্টির বায়োডাটায় নিজকে পরিচয় দিয়েছেন অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে এবং সেখানে তার ধর্ম সনাতন। অনেকের ধারণা তিনি সনাতন ধর্ম গ্রহণ করেও থাকতে পারেন। বৃষ্টি খাতুন বা অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর পুরো বিষয়টি রহস্যের এবং অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও এখানে সব ধর্মের মানুষেরই সমান মর্যাদা। এজন্যই অনেকের মনে একটি প্রশ্ন বেশি জেগেছে, সে মুসলিম হলে নিজকে সনাতন ধর্মাবলম্বী হিসেবে কেন পরিচয় দিবে? আবার সনাতন ধর্ম গ্রহণ না করে থাকলে নিজেকে অভিস্রুতি শাস্ত্রী নামে কেন পরিচয় করাবে অথবা মিডিয়াতে এই নামে কেন পরিচিত হবে? সব প্রশ্নের জবাব না পাওয়া গেলেও হয়তো অচিরেই অনেক জিজ্ঞাসার উত্তর প্রকাশিত হবে। কেটে যাবে সব ধোঁয়াশা কিন্তু বৃষ্টি খাতুন ওরফে অভিস্রুতি শাস্ত্রী কখনোই ফিরে আসবেনা। এভাবে দুর্ঘটনায় কত স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। ভেঙ্গে গে‌ছে কতনা সাজানো সংসার। আগুনের সর্বগ্রাসী থাবায় মানুষের আর্তনাদ যেন এখনো প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরছে আমাদের কানে। এমন বড় বড় দুর্ঘটনার নজির যেমন আছে তেমনি বাসা বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, এসি, ফ‌্যান, রেফ্রিজারেটরসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে আগুন লেগে অগ্নিদগ্ধ ও মৃত্যুর ঘটনা প্রতি‌নিয়ত ঘটেছে। আমরা এমন দুর্ঘটনা আর চাইনা।

এখনই সময় সচেতন হবার, জেগে ওঠার। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যথাযথ অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা রাখতে হবে। আবাসিক এলাকায় কল কারখানা ও দাহ্য পদার্থের দোকান রাখা যাবে না। আমাদের বাড়ি ঘর নির্মাণ, কল কারখানা স্থাপনসহ যাবতীয় কাজে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে। জীবনের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয় এমন কোন কাজ করা যাবে না।

মনে রাখতে হবে, অসাবধনতাই অগ্নিকান্ডের প্রধান কারণ তাই অগ্নি প্রতিরোধে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন, রান্নার পর চুলা সম্পূর্ণভাবে নিভিয়ে ফেলতে হবে। ভেজা জামা কাপড় চুলার উপর শুকাতে দেওয়া যাবেনা।গ্যাসের চুলা জ্বালানোর পূর্বে কমপক্ষে ১৫ মিনিট পূর্বে রান্নাঘরের সকল জানালা/দরজা খুলে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্যাসের চাবি অন করার পূর্বে ম্যাচের কাঠি ধরানো যাবে না। গ্যাসের চুলার হোজপাইপটি ফাটা/ক্ষতিগ্রস্থ হলে পরিবর্তন করতে হবে।

ক্ষতিগ্রস্থ/নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার/সরঞ্জাম প্রতিস্থাপন করতে হবে। বাসাবাড়ির বৈদ্যুতিক লাইন প্রতি ০৬ মাস অন্তর অন্তর নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে।  সঠিক মানের বৈদ্যুতিক তার/সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে।  অব্যবহৃত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম মূল লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। ছোট ছেলেমেয়েদের আগুন নিয়ে খেলা থেকে বিরত রাখতে হবে। খোলা বাতির ব্যবহার যাবে না।বাসাবাড়ি/প্রতিষ্ঠান অগ্নি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। হাতের কাছে সব সময় দুই বালতি পানি বা বালু রাখতে হবে। অগ্নি ঝুঁকি অনুসারে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্র মজুদ রাখতে হবে। মাঝে মাঝে তা পরীক্ষা করতে হবে। 

অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের প্রয়োগ ও ব্যবহার বিধি সম্পর্কে সবাইকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অগ্নি দুর্ঘটনায় যে সকল প্রাণহাণীর ঘটনা ঘটে থাকে তার জন্য আগুনজনিত ধোঁয়াই দায়ী।কখনও যদি নিরাপদ স্থানে গমনের জন্য ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হয় সেক্ষেত্রে কিছু পন্থা অবলম্বন দরকার। মনে রাখতে হবে ধোঁয়া বাতাস অপেক্ষা হালকা তাই উর্দ্ধমূখী। এজন্য যে ফ্লোরে আগুন তার নিচের ফ্লোরে বা খোলা জায়গায় চলে আসতে হবে। ধোঁয়াময় স্থান দৌড়ে অতিক্রম করা যাবেনা। হামাগুঁড়ি দিয়ো বের হয়ে আসতে হবে কেননা ফ্লোর হতে ৩০ থেকে ৬০ সে.মি. পর্যন্ত বিশুদ্ধ বাতাস থাকে।

অ‌গ্নি দুর্ঘটনা প্রতি‌রো‌ধে সমা‌জের সবাই‌কে স‌চেতন হ‌তে হ‌বে। আমা‌দের ফায়ার সা‌র্ভিসের সদস‌্যদের আ‌রো বে‌শি যোগ‌্য ক‌রে গ‌ড়ে তুল‌তে হ‌বে। এক‌দিন সব প্রাণি‌কে মৃত‌্যুর স্বাদ গ্রহণ কর‌তে হ‌বে। ত‌বে সেই মৃত‌্যু‌টি যেন হয় স্বাভা‌বিক মৃত‌্যু্ এমনই সবার প্রত‌্যাশা।
লেখকঃ খান নজম-ই-এলাহি, গণমাধ্যম কর্মী।

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.