আদর্শ মানুষঃ শিশুর ধর্মীয় মূল্যবোধ, শিক্ষা ও নৈতিকতা
সমাজ-সভ্যতা এগিয়ে চলছে। বিশ্বায়নের যুগে নিজকে গুটিয়ে রাখলে চলবে না। নারী-পুরুষ সবাইকে এগুতে হবে। কিন্তু এগিয়ে চলার ধরণ কতটা ইতিবাচক সেটাও বিবেচ্য বিষয়। নিজস্ব সংস্কৃতি উপেক্ষা করে এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এখন স্মার্টফোনে সারা বিশ্ব। জীবনের প্রতিটি কাজে আমরা স্মার্টফোন নির্ভর হচ্ছি। কিন্তু এরও ভালো দিক, মন্দ দিক রয়েছে। আমরা কিভাবে ব্যবহার করছি এটাই বিষয়। কোভিড-১৯ এর সময় থেকে দূর শিক্ষণে শিক্ষার্থীদের হাতে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মার্টফোন আসে। এখন ২০২৪ শে এসে শিক্ষার্থীদের মাঝে স্মার্টফোন নির্ভরতা একটুও কমেনি বরং বেড়েছে।
প্রশ্ন জাগে এটাকি শুধুই কল্যাণ বয়ে আনে? অকল্যাণের কিছু নেই? স্মার্টফোন কল্যাণের সাথে অকল্যাণ নিয়ে আসছে এটা সকলেই স্বীকার করবে। ইউটিউভ, ফেসবুকসহ বিভিন্ন ওয়েভসাইটে শিক্ষামূলক ভিডিও ও তথ্যের পাশাপাশি চরিত্র ও মেধাহরণকারী অনেক কিছুই রয়েছে। যা আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। আবার অনেকে পরীক্ষায় ভালো ফল লাভ করলেও সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে সরে আসতে পারে। তাছাড়া ভিনদেশী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন একটি জাতির মূল সাংস্কৃতিক ধারাকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে। যেমন, পশ্চিমাদের মত ছোট ছোট পেশাকপরা বা লিভ টুগেদার করা বাঙালি সমাজে নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে বাঙালি হয়েও একজনের মনে এসবের প্রতি অনুরাগ তৈরি হতে পারে যা বাঙালি শিল্প সংস্কৃতির জন্য সুখকর নয়। তাই একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষার পাশাপাশি মানবিকতা, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা অর্জন করতে হবে।
শিক্ষা ব্যক্তিকে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারমুক্ত করে আলোকে নিয়ে আসে।
নৈতিকতা জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে। শিক্ষার সাথে সাথে নৈতিকতা একজন মানুষকে সৎ, চরিত্রবান, দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বশীল করে তোলে। ব্যক্তি শিক্ষিত হতে পারে কিন্তু তার মধ্যে যদি মানবিকতাবোধ, নৈতিকতা না থাকে তবে তার শিক্ষায় সমাজের কোন উপকারে আসে না। আমি অন্যের কাছ থেকে যেমন আরচণ বা কাজ প্রত্যাশা করি আমারও তেমন হওয়া উচিত। একটি সমাজে যখন এমন শিক্ষিত আদর্শ ব্যক্তির সংখ্যা বাড়তে থাকবে সেই সমাজ দ্রুত এগিয়ে যাবে। একটি রাষ্ট্রের নিম্ন স্তর থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে যারা সরাসরি জড়িত আছে তাদের সততা ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা নিশ্চয়ই দেশকে এগিয়ে নিবে।
আমরা মূল্যবোধ বলতে কোন সমাজে প্রচলিত বা প্রত্যাশিত জীবনব্যবস্থাকে বুঝে থাকি। যেমন-যে মুসলিম মেয়েটি শহরে বসে খুব আধুনিক বা ওয়েস্টার্ন স্টাইলের পোশাক পরলেও তার গ্রামে গেলে সাধারণ শালীন পোশাক পরছে। কারণ গ্রামের মানুষ বা ঐ সমাজ একটি মেয়েকে এভাবেই দেখতে পছন্দ করে। আধুনিক বা ওয়েস্টার্ন সব পেশাক অশালীন বিষয়টি এমন নয়। এটা সামাজিক চাহিদা বা মূল্যবোধের বিষয়। তবে এই সামাজিক মূল্যবোধ কালক্রমে পরিবর্তিত হতে পারে। দিন দিন মূল্যবোধ সংস্কারের দিকে যাচ্ছে। একটি ভুল কথা, কাজ, আচরণ সমাজে প্রচলিত থাকতে পারে তাই বলে সমাজ এটি নিয়ে পড়ে থাকবে তাও সঠিক হবেনা।
সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সমাজ ভালো কিছু গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক। অনাদিকাল থেকে সামাজিক মূল্যবোধ সমাজের উপকারের জন্যই। তবে ইতিবাচক পরিবর্তন সব সময়ই প্রত্যাশিত। সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিটি সমাজে বা বিভিন্ন বয়সের ব্যক্তির মাঝে ভিন্নতর হলেও নৈতিকতা সবার উপরে সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন, মানুষ সত্য কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই উচিত। পৃথিবীর সব দেশের, সব সমাজের, সব বয়সের মানুষের সত্য বলা উচিত। আর এটিই হল নৈতিকতা। নৈতিকতা হচ্ছে সব সময় বিবেক দিয়ে ইতিবাচক কিছু করা। সেটা হতে পারে কোন ব্যক্তির জন্য, নিজের জন্য, দেশের জন্য। নৈতিকতা সবার উপরে সমানভাবে প্রযোজ্য। নৈতিকতার আবেদন সর্বজনীন। নৈতিকতা বোধ সম্পন্ন মানুষ পৃথিবীর সবার কল্যাণে কাজ করতে পারে। এমনকি প্রকৃতির ক্ষুদ্র পিপীলিকাও তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আমরা অপ্রয়োজনে অকারনে কেন একটি ক্ষুদ্র পিপীলিকার ক্ষতির কারণ হবো? নৈতিকতা বোধে অনন্য ব্যক্তির কাছে সবাই নিরাপদ থাকবে।
এবার আসি ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রসঙ্গে। পৃথিবীতে অসংখ্য ধর্ম রয়েছে। যেমন ইসলাম ধর্ম , খ্রিস্ট ধর্ম, ইহুদী ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ইত্যাদি। প্রতিটি ধর্মের প্রচারকগণ সত্য সুন্দরের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। একজন মুসলিম হিসেবে বলতে পারি ইসলাম ধর্ম মানুষকে আলোর পথে পরিচালিত করে। ইসলাম ধর্ম মানুষকে সকল প্রকার অন্যায় পাপাচার থেকে বিরত রেখে কল্যাণের পথে ধাবিত করে।
পবিত্র ধর্ম ইসলাম হলো একটি সহজ-সরল, সর্বজনীন ও চিরন্তন পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের সুমহান আদর্শের আলোকে যে জীবন গঠন করবে সে সব ধরণের অন্যায় থেকে দূরে থাকবে। অন্যের কল্যাণ কামনা করবে। একটি পরোপকারী ও মিতব্যয়ী জীবন গঠন করবে। সে খুঁজে পাবে দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির পথ।
একজন পরিপূর্ণ মুসলিম কখনো ধর্ষক হবে না। মিথ্যে বলবে না। অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করবে না। শাসক হলে ন্যায়বান শাসক হবে কখনো শোষক হবে না। কারণ ইসলাম কখনো জুলুম অত্যাচার সমর্থন করে না। কোন নামধারী মুসলিমের কাজ বিচার করে মুসলিম জাতি বা ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোন সুযোগ নেই। প্রত্যেক মুসলিমের উচিত ইসলামের সুমহান আদর্শ মেনে চলা। মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও মহানবী (স.) এর সহীহ হাদীসের আলোকে জীবনকে পরিচালিত করা।
একজন সত্যিকারের মুসলিম মনে প্রাণে বিশ্বাস করে পবিত্র ইসলাম হচ্ছে শান্তি ও মুক্তির ধর্ম। তাই ইহলৌকিক শান্তি ও পারলৌকিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। শিশুকাল থেকে সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে। ইসলামের আলোকে চরিত্র গঠনে উৎসাহিত করতে হবে। শৈশব ও কৈশোর থেকে কাউকে দিয়ে যদি সুন্দরের চর্চা করানো যায় তাহলে তার যৌবনও সঠিক পথে পরিচালিত হবে। অন্তত সে ধর্ষক হবে না। কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরী করে মিষ্টি বিতরণ করবে না। মেয়েদের প্রতি সম্মান রাখবে।
ইসলাম অশালীন পোশাক পরা, পর্ণোগ্রাফি দেখা, পরকীয়া, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক সম্পর্কে কঠিন হুশিয়ারী দিয়েছে। যেনা, ব্যভিচার ও ধর্ষণের স্পষ্ট উচ্চারণ রয়েছে পবিত্র আল কুরআনে। একজন মুসলিম সে যে মাধ্যমেই পড়াশোনা করুক না কেন তাকে এ বিষয়গুলি জানতে হবে এবং মেনে চলতে হবে। একজন মুসলিম যুবক হবে আদর্শ যুবক। সে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সম্মানিত গ্রহণীয় ব্যক্তি হবে। সে হবে সমগ্র দেশ তা বিশ্বের জন্য কল্যাণকর। আধুনিকতার নামে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া যাবেনা। ইসলামই বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ধর্ম।
পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার নাম ইসলাম এটাকে শক্তভাবে মনে স্থান দিতে হবে। আদর্শবান তরুণ প্রজন্ম পেতে হলে ছোটবেলা থেকে শিশুদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, সুশিক্ষা ও নৈতিকতার গুণাবলী অর্জনের পথ দেখাতে হবে। মানব জীবনে ইসলামের নির্দেশিত পথে চলার গুরুত্ব অপরিসীম। কিছু বিষয় আছে খুবই সামান্য মনে হলেও আসলে তা সামান্য নয়। প্রস্রাব, পায়খানার পর যে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা তাও ইসলামে বলা আছে। প্রস্রাব, পায়খানার পর পরিচ্ছন্নতা অর্জন না করলে বিভিন্ন রোগ ব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার কথা বিজ্ঞান দ্বারাও প্রমানিত। ইসলামের প্রতি কথা ও কাজে আমরা কল্যাণ দেখতে পাই।
মহান আল্লাহর আনুগত্য লাভের জন্য পবিত্রতা অর্জন করতে হবে। পবিত্রতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মোমিন মুসলিমের অন্যতম গুণ। ইসলাম মানুষকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা দিয়েছে। এমনকি মৃত্যুর পরে মৃত ব্যক্তিকে পরিচ্ছন্ন করে কিভাবে কবরে রাখতে হবে তাও বলা হয়েছে পবিত্র ইসলামে। শিশুদের পরিচ্ছন্নতার গুণ অর্জন করতে হবে। নিয়মিত গোসল করলে, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য অযু করলে ইহলৌকিক ও পরলৌকিক কল্যাণ সাধিত হয় এমন শিক্ষা দিতে হবে। একটি শিশুকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে অবশ্যই তাকে একাডেমিক শিক্ষার সাথে সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বিষয়েও জ্ঞান দিতে হবে।
লেখকঃ খান নজম-ই-এলাহি, গণমাধ্যম কর্মী।