ট্রাফিক পুলিশের মানবিকতা

0

ধুলোবালি রোদ-বৃষ্টি, ঝড় ও শব্দ দূষণ যেনো ট্রাফিক পুলিশের নিত্যসঙ্গী। দিন-রাত রাস্তায় দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয় তাদের। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে নানান বিড়ম্বনা। গাড়িরচালক ও পদচারীদের বেশিরভাগেরই রয়েছে আইন ভাঙ্গার প্রবণতা। আইন মানাতে ট্রাফিক পুলিশকে অনেকটা হুমকি-ধমকির মুখোমুখি হতে হয়। তবুও এতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দায়িত্ব পালন করতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে।

ঢাকার চাকা সচল রাখতে এক নাগাড়ে ৮ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করে ট্রাফিক পুলিশ। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গাড়ির বিকট শব্দে কিডনি, হার্ট, কান ও মস্তিষ্কসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জটিল সমস্যা হয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

এ কারণে ট্রাফিক পুলিশের বিশ্রামে প্রয়োজন হয়। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক পুলিশের বসার স্থান তৈরি করা হয়, যা ট্রাফিক পুলিশ বক্স নামে পরিচিত।

একটানা দাঁড়িয়ে থাকার পর কিছুক্ষণের জন্য ঐ এক রুমের বক্সে গিয়ে বসে বিশ্রাম নেন ট্রাফিক পুলিশরা। ওখানে বসেও গ্লাসের ভেতর দিয়ে ট্রাফিক কার্যক্রম দেখভাল করা যায়। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ট্রাফিক পুলিশ বক্স ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটাকে চরম অমানবিক আখ্যায়িত করে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের একাধিক সদস্য বলেন, ট্রাফিক পুলিশও এদেশের মানুষ। তারাও সমাজের বাইরে না। সারাদিন কর্মব্যস্ত সময় পার করার পর দিনশেষে নির্বিঘ্নে আপন ঠিকানায় পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করছি। একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাথা ঘোরায় ও পা ব্যথা হয়ে যায়। পুলিশ বক্সে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলে সেই কষ্ট কিছুটা লাঘব করা যায়। কিন্তু, বিকল্প ব্যবস্থা না করে সেই বক্সও ভেঙে ফেলা হচ্ছে।

ট্রাফিক পুলিশের একাধিক সদস্য বেশ আক্ষেপের সুরে বলেন, ট্রাফিক পুলিশের ওয়াশরুমের কোনো ব্যবস্থা নেই; বৃষ্টি হলে আশ্রয় নেওয়ার কোনো জায়গা নেই; অথচ যতই প্রতিকূল পরিস্থিতি হোক না কেন আমাদের রাস্তা ছেড়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। কাজের ফাঁকে একটু বিশ্রাম নেওয়া, বসে খাওয়া-দাওয়া করার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরাও তো মানুষ।

পৃথিবীর অনেক দেশে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের বিশ্রামের জন্য বাথরুমসহ এসি রুম থাকে। বিশ্বের অনেক দেশেই দাঁড়িয়ে কোনো ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি করে না। রুমের মধ্য থেকে গ্লাস দিয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেন। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পদচারীর দুর্ব্যবহার ও দুর্ঘটনাসহ নানা ঝুঁকির মধ্যে ব্যস্ততম সড়কে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। যানজটের জন্য পুলিশের দায় অত্যন্ত কম। রাস্তার সীমাবদ্ধতা, সড়ক আইন অমান্য করার প্রবণতা, ফুটপাত দখল, হকার ইত্যাদি কারণে ঢাকায় যানজট বেড়েছে। তবুও পুলিশকেই যানজটের জন্য নিত্যদিন সাধারণ মানুষের গালমন্দ শুনতে হয়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে ট্রাফিক পুলিশকে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি দেওয়া প্রয়োজন।

সম্মানিত নগরবাসী যখন ঘুমিয়ে থাকেন, তখন ঢাকা মহানগরীতে ট্রাফিক পুলিশসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার প্রায় ৮০০০ পুলিশ সদস্য রাজ জেগে দায়িত্ব পালন করে। তারপরও, পুলিশের সঙ্গে অমানবিক ও বিমাতাসূলভ আচরণ করা হচ্ছে। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত।

মনে রাখতে হবে, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো জন্মযোদ্ধা পুলিশ। করোনার সময় মা ছেলেকে ফেলে রেখে চলে গেলেও, লাশ দাফন করার জন্য আপন লোক পাশে না থাকলেও পুলিশ তাদের দাফন করেছেন। করোনা আক্রান্ত মা-বাবাকে রাস্তায় ফেলে রেখেছিল সন্তানরা। সেই সব বাবা-মাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে পুলিশ। আমরা যে করোনায় আক্রান্ত হতে পারি, সেদিকেও কেউ তাকায়নি। ক্ষুধার্ত মানু্ষের দ্বারে দ্বারে খাদ্যসামগ্রী পৌছে দিয়েছে সম্মুখসারির অন্যতম প্রধান যোদ্ধা পুলিশ। জাতির যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে পুলিশ পিছনে ফিরে তাকায়নি। নিরবচ্ছিন্নভাবে মানবতার সেবা দিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।

একজন ট্রাফিক কনস্টেবলের ভাষ্যে, ‘আমাদের কষ্টের শেষ নেই। পানি খাওয়ার জন্য সরতেও পারি না। সরলেই রাস্তায় গাড়ির যানজট লেগে যায়। পুলিশের পোশাক গায়ে ধুলোবালির কারণে বেশির ভাগ সময়েই তা অপরিষ্কার ও ময়লা হয়ে যায়। দাঁড়িয়ে ডিউটি করতে করতে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি যে সেটা এখন টের পাচ্ছি।’

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের (এনআইএনএসএইচ) পরিচালক প্রখ্যাত নিউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ বলেন, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ডিউটি করলে কোমরে ব্যথা হতে পারে। শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে গিয়ে মাথা ঘোরায়। যে কেউ হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ওয়াদুদ চৌধুরীর মতে, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে পায়ের শিরায় রক্ত জমাট বাঁধে। হার্টের মধ্যে রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হয়। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মৃত্যুও হতে পারে। এ ধরনের ঘটনা মাঝেমধ্যে ঘটছে। অন্যান্য সমস্যাও হতে পারে। এজন্য ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম প্রয়োজন।

রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কোমরে ও হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে। একটানা দাঁড়িয়ে ডিউটি করা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাদের এক ঘণ্টা পরপর ২০ সেকেন্ডের জন্য বিশ্রাম নেওয়া খুব প্রয়োজন।

প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, রোদে ডিউটি করলে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তীব্র উৎকণ্ঠা কাজ করে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘক্ষণ ডিউটি করার কারণে রক্তের শ্বেতকণিকারও বেশ ঘাটতি হয়।

আমরা কেবলই বাইরেরটা দেখি; ভেতরেরটা দেখি না। পুলিশকে শত্রু নয়; বন্ধু ভাবুন। পুলিশ সবসময় আপনার পাশে আছে ও থাকবে।

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.